কালীগঞ্জ টিভি ডেস্ক: ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের নামে গাজীপুরে ৬০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত একটি রিসোর্ট পাওয়া গেছে। আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট নামে রিসোর্টটি গাজীপুর মহানগরীর পুবাইল থানাধীন ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের খিলগাঁও এলাকায় অবস্থিত। ওই এলাকায় বর্তমানে প্রতি কাঠা জমির মূল্য ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা হবে। এছাড়া টঙ্গীতে পাওয়া গেছে তার ভাইয়ের নামে কারখানা। রয়েছে মতিউরের নামে বিভিন্ন ভূসম্পত্তি।

গাজীপুরেও রয়েছে ছাগলকাণ্ডের মতিউরের ‘সাম্রাজ্য’

পূবাইলে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন রিসোর্টটিতে বিনোদনের জন্য রয়েছে বাঁশের ঘর, বেতের ঘর, লাইটিং ঘর, সাজ ঘর, সুসজ্জিত ড্রয়িং রুম, আধুনিক কনফারেন্স হল, ডাইনিং স্পেস, আমবাগান, লেকের সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ, মনোরম লেক, রেস্টুরেন্ট, ডলফিন এরিয়া, ক্রিকেট মাঠ, ফুটবল মাঠ, ব্যাডমিন্টন মাঠ, আরসিসি চায়না হোম। উত্তর দিকের বিস্তৃত বাগান, কাচের মঞ্চ, গ্রিনহাউস, বক ফোয়ারা, বাংলো ঘর, মাছ ধরার পুকুর ও কাঠের ঘর ইত্যাদি।

পূর্বে এখানে শুটিং হলেও বর্তমানে রিসোর্টটিতে ১০০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে যে কেউ সেখানে সময় কাটাতে পারে। ফলে এখানে দীর্ঘদিন ধরে চলছে অসামাজিক কাজ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিসোর্টটির প্রচারণায়ও এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রচারণায় বলা হয়েছে, সব প্রকার নাটক, সিনেমা অথবা বিজ্ঞাপনের শুটিং আর পিকনিকের জন্য মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন রিসোর্ট। এছাড়া একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ভালো সময় কাটানোর জন্য ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছু সময় কাটাতে পারেন। এখানকার প্রকৃতির শান্ত পরিবেশ আপনাকে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে। পূবাইল, খিলগাঁও রেলগেটের কাছে গাজীপুরে অবস্থিত রিসোর্টটিটে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি আনন্দের অনুভূতি অনুভব করবেন।

পার্কের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী লায়লা কানিজের অনেক আগে থেকেই টঙ্গী এলাকায় আসা যাওয়া ছিল। সেই সূত্র ধরে স্থানীয় প্রভাবশালী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে তার সখ্যতা তৈরি হয়। পরে রাজধানীর উত্তরা থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পূবাইলের খিলগাঁও এলাকায় আমিনুল ইসলামের বাড়ির আশপাশে মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ৩৫ বিঘা জমি ক্রয় করেন। পরে তিনি আরও কিছু জমি ক্রয় এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে জমি বাৎসরিক ভাড়া নিয়ে ৬০ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেন ‘আপন ভুবন’ নামের পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাসবহুল কটেজ, বিভিন্ন রাইডসহ অসংখ্য স্থাপনা ও ১৮টি কটেজ। কটেজে প্রতি রাতের জন্য ভাড়া গুনতে হয় ৭ হাজার টাকা। এছাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকার টিকেট কেটে সারাদিন সেখানে সময় কাটানো যায়। ঘুরতে যাওয়াদের জন্য আছে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা।

পার্কটি দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত আছেন এক তত্ত্বাবধায়কসহ ১২ জন কর্মচারী। পার্কে ঘুরে দেখার জন্য তেমন কিছু না থাকলেও ঢাকার কাছে সকাল সন্ধ্যা সময় কাটানোর জন্য এবং অশালীন কার্যকলাপের জন্য খুবই পরিচিতি লাভ করেছে এই পার্কটি।

স্থানীয় দোকানদার শরিফ হোসেন বলেন, আমরা সবাই জানি আপন ভুবন কানিজ ম্যাডামের। এখন জানতে পারছি এ ম্যাডাম মতিউরের বউ। আগে শুটিং হতো। গত ১ বছর ধরে ১০০ টাকা করে টিকেট করেছে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা এ রিসোর্টে এখন বেশি আসে। তারা সকালে আসে বিকেলে বের হয়। ভেতরে কী করে আল্লাহ জানে।

স্থানীয় অটোচালক খোরশেদ আলম বলেন, এখানে জমি কেনার সময় মতিউর রহমান বলেছিলেন শিল্প কারখানা করবেন। যার কারণে মানুষ আগ্রহী হয়ে তাদের কাছে জমি বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি এখানে পার্ক তৈরি করেন এবং এখন এখানকার অশালীন কাজের জন্য অতিষ্ঠ। প্রতিদিন অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ভেতরে যান। তাদের মধ্যে অল্প বয়সের যুবক যুবতীরাই বেশি থাকে। ছোট ছোট ঘরগুলো লাতাপাতা গাছ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে বসে যুবক-যুবতীরা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকেন।

ওই পার্কে প্রবেশের টিকেট বিক্রেতা আব্দুর রশিদ জানান, পার্কটি চালু হয়েছে প্রায় ১২ বছর আগে। যেদিন পার্কটি চালু হয়েছে সেদিন থেকেই তিনি ওখানে কাজ করছেন।

পার্কের অপর টিকেটম্যান মেহেদী বলেন, এখানে কয়েকজনের জমি আছে। মতিউর স্যারেরও আছে, আরও অনেকেরই আছে। সবার নাম আমি জানি না, অল্পদিন ধরে এখানে কাজ করি। গাজীপুরে এর থেকে অনেক ভালো ও বড় রিসোর্ট আছে, যাদের টাকা আছে তারাই এসব বানায়।

এদিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আপন ভুবন রিসোর্ট অ্যান্ড পিকনিক স্পটের নামে ৫ একর ৭৭৭ শতাংশ জমি নামজারি জমাভাগ করা হয়েছে। উল্লিখিত রিসোর্ট ছাড়াও মতিউর, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে আরও জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। গাজীপুর মহানগরীর পুবাইল থানাধীন খিলগাঁও মৌজায় মতিউরের পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ জমি নামজারি ও জমাভাগ করা হয়েছে।

গাজীপুর জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খিলগাঁও মৌজায় ৩৬৫৬নং জোত নম্বরে মতিউরের নামে ২৭ শতাংশ এবং ৪২৪৯ নং জোতে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ নামজারি করা হয়েছে। একই মৌজায় মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ৩৪৫০নং মৌজায় ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি খারিজ করা হয়েছে। একই মৌজায় মতিউরের প্রথম পক্ষের সন্তান অর্ণবের ৩৬৪৮নং জোতে ১৯ শতাংশ, ৪৪১৫ জোতে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ, ৪৪১৬নং জোতে ৫৫ শতাংশ, ৩৯৫০ জোতে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি নামজারি জমাভাগ করা হয়েছে। একই মৌজায় মতিউরের মেয়ে ফারজানা রহমানের নামে ৩৯২৫নং জোতে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৩৬৪৫নং জোতে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি খারিজ করা হয়েছে।

এছাড়া মতিউর, তার স্ত্রী ও মেয়ের যৌথ নামে ৩৫৫৭নং জোতে ৪৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং লায়লা কানিজ ও সন্তান তৌফিকের নামে ৩৬৫২নং জোতে ৪৫ শতাংশ জমি নামজারি জমাভাগ করা রয়েছে। এসব জমি তাদের দখলে রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। এছাড়াও গ্লোবাল সুজের নামে খিলগাঁও মৌজায় ২১, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭১, ৭২, ৭৪, ৭৫, ৯১, ৯২, ১১৪, ১২০, ১২১, ১২২, ১২৩ ও ১২৪নং জোতে শিল্প খারিজ করে জমাভাগ করা ৬৫ শতাংশ জমি রয়েছে।

এসব ছাড়াও লায়লা কানিজের নামে-বেনামে গাজীপুরে আরো জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, গাজীপুরে পাঁচ কাঠা, গাজীপুরের পূবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ জমি রয়েছে।

এদিকে টঙ্গীতে মতিউরের ভাইয়ের নামে কারখানা ও জমি রয়েছে। আইনগত ঝামেলা এড়ানোর জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ গড়েছেন মতিউর রহমান। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও এক্সেসরিজ কারখানা আছে তার। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তার ভাই এমএ কাইয়ুম হাওলাদার।

এছাড়া স্থানীয়রা জানান, জোর জবরদস্তি করে অনেকের জমি নিয়েছেন মতিউর।

বর্ডারের ওই পারে প্রভু নেই, বন্ধু আছে: মির্জা আব্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Tags