হাত-পা-চোখ বেঁধে একে একে ৮টি নখ তুলে ফেললো, বেরিয়ে এলো লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা

Posted by

দেশজুড়ে: পেছন থেকে তিন-চারজন লোক হঠাৎ জাপটে ধরল। টেনে গাড়িতে তুলেই দুই হাতে হ্যন্ডকাফ পরিয়ে ফেলল। পেছন থেকে একজন মাথায় কালো জমটুপি পরিয়ে দিল। গাড়ি চলতে থাকল। ত্রিশ মিনিটের মতো চলে থেমে গেল। আমাকে নামানো হলো। পেছন দিক দিয়ে হাত বাঁধা। দুই হাতের নিচ দিয়ে দু’জন শক্ত করে ধরে হাঁটতে শুরু করল। মনে হলো, কোনো লিফটে উঠাল।

আবার নামানো হলো। কত তলায় উঠলাম বুঝতে পারিনি। লিফট থেকে বের হয়ে একটু হেঁটেই আমাকে একটি চেয়ারে বসানো হলো। মুখের ভেতরে কাপড় বা গামছা জাতীয় কিছু একটা দিয়ে শক্ত করে মুখ বেঁধে ফেলল। চোখ-মুখ-পা সবই বাঁধা। সজোরে কোমর থেকে পায়ের পাতা সবখানে মোটা লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করল। তিন-চার মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। চেয়ার থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। এভাবে টানা তিন দিন থেমে থেমে মারল। একে একে আমার পায়ের আটটি নখ তুলে ফেলল। আমার সামনে গরম পানি নিয়ে আসলো। কাটিং প্লাস আনলো। বললাম, আমি বাঁচতে চাই। আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবেন না।

কথাগুলো বলছিলেন. জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. আমানউল্লাহ আমান। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার মহাখালী এলাকায় একটি মিছিলের পূর্বপ্রস্তুতির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি কেরাণীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান আমান।

আমানউল্লাহ আমানের জন্ম ১৯৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দক্ষিণের জেলা বরগুনার সদর উপজেলায়। স্কুল শিক্ষক বাবা মৃত আ. রহিম মুন্সী এবং মা আম্বিয়া খাতুনের ৪ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে ৬ষ্ঠ সন্তান তিনি। ২০২১ সালে বাবা রহিম মুন্সী মারা যান। ৭৩ বছর বয়সী আম্বিয়া খাতুন দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় ভালো ছিলেন আমান। বরগুনা সদর উপজেলার পরীরখাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আমান ২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেই একাদশ শ্রেণিতে ভর্তী হন ঢাকার তেজগাঁও কলেজে।

এরপর ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে ভর্তী হয়ে স্নাতক ও স্নাতকত্তোর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানী ভাষা স্টাডিজে স্নাতকত্তোরে অধ্যায়নরত আছেন এই ছাত্রনেতা। তুল নেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতন নিয়ে কথা বলেন বাংলা আউটলুকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি। নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো-

বাংলা আউটলুক: মামলা হামলায় জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা কী?
আমানউল্লাহ আমান: সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট আমাকে যেভাবে গ্রেফতার করে এবং এর পরের ভয়াবহতা কোনোদিন ভুলতে পারব না।

বাংলা আউটলুক: একটু খুলে বলবেন?
আমানউল্লাহ আমান: ওই দিন দুপুর দুইটার দিকে প্ল্যনিং কমিশনের সামনে একটা বিক্ষোভ মিছিলের প্রস্তুতি ছিল। সারাদেশে তখন প্রচুর ধরপাকড় চলছিল। আমাদের নির্ধারিত স্পটের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখে, স্থান পরিবর্তন করে মহাখালী জড়ো হতে বলি সবাইকে। মহাখালী গিয়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমাকে সাদা পোশাকের লোকজন ঘিরে ফেলে। গাড়িতে ওঠানোর সাথে সাথেই কালো জমটুপি পরি দেয়য়ে। এ সময় আমি বাধা দিতে চাইলে, অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। হাতে হ্যন্ডকাফ লাগিয়ে ফেলে। ৩০ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে আমাকে নামানো হলো। আমার মনে হয়েছে, লিফটে আমাকে কোনো ভবনের ওপরের দিকে তোলা হলো। কিন্তু চোখ বাঁধা থাকায় আমি কিছুই দেখতে পারিনি।

বাংলা আউটলুক: সেখানে নেয়ার পর কী হলো?
আমানউল্লাহ আমান: লিফট থেকে নামিয়ে একটু হাঁটিয়ে একটি কক্ষে নিয়ে চেয়ারে বসায়। হ্যন্ডকাফ সামনের দিক থেকে পেছনের দিক দিয়ে দুই হাতে লাগায়। মুখের ভেতরে কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। মাথায় আগে থেকেই জমটুপি পরানো ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চার দিক দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত শুরু করে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত লাঠি দিয়ে বেধড়ক পোটাতে থাকলো। মাথার চুল ধরে চড়, ঘুষি দিতে থাকলো। যতটুকু মনে পড়ে, দ্রুতই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এরপর কতক্ষণ পিটিয়েছে, আমি আর কিছুই বলতে পারব না। জ্ঞান ফিরলে আমি অনুভব করি মেঝেতে পড়ে আছি। আমার দুই হতের বাহু, উরু, কোমর, পায়ের পাতা সবই ফুলে গেছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কথা বলার মতো শক্তিও আমার ছিল না। প্রচন্ড শীত ছিল ওই সময়। আমার শরীরে পাতলা একটি শার্ট, পরনে প্যান্ট, খালি পা। মেঝেতে পাড়ে আছি। কেউ একজন আমাকে একটি বালিশ, কম্বল দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার এতটুকু শক্তি শরীরে ছিল না যে বালিশটা টেনে মাথার নিচে দিই বা কম্বলটা গায়ে জড়াই। এভাবেই কেটেছে তিন দিন। দু’দিন আমার চোখ থেকে ওই জমটুপি একবারের জন্যও খোলা হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম টয়লেটে যাওয়ার কথাও।

বাংলা আউটলুক: কোনো কথা হয়নি?
আমানউল্লাহ আমান: হ্যাঁ। আমার হাত, চোখ, মুখ সবই বাঁধা। নির্যাতনের ফাঁকে ফাঁকে তারা আমাকে একটি হত্যা মামলার দায় স্বীকার করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। আমাকে নিয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় দিন রাতে নির্যাতনের একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। একজন ডাক্তার আনা হলো, আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়া হলো। একটি ট্যবলেট খাওয়ানো হলো। আর কী যেন একটা স্প্রে করা হলো। ডাক্তার বললেন, জমটুপিটা একটু খুলে রাখার জন্য। ব্যথা কিছুটা কমলেও আমার শরীরে কোনো শক্তি ছিলো না। উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও ছিলো না। তাদেরই দু’জনের কাঁধে ভর করে আমি টয়লেটে গেলাম। এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আবার ডেকে পাঠালো। জমটুপি পরানো হলো। কিছুই দেখছি না। প্রচন্ড জোরে আমার পায়ে, কোমরে, হাতের বাহুতে পেটানো শুরু করল। হাত, পা সবই বাঁধা। তাদের অন্তত ৫-৬ জনের নির্যাতনে আমি চেয়ারসহ মাটিতে পড়ে গেলাম। অনেকটাই অচেতন। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, তারা বলা বলি করছিল; আমার নখ তুলে ফেলা হবে। শক্ত কিছু একটা দিয়ে আমার ডান পায়ের তিনটি নখ টেনে তুলে ফেলল।

সূত্র: বাংলা আউটলুক

Tags